রায়হান আহমেদ, চুনারুঘাট : হবিগঞ্জ জেলার অন্যতম শস্য-শ্যামল উপজেলা নামে খ্যাত চুনারুঘাট। পর্যটকদের মন কাড়া হরেক প্রজাতির বন্য প্রাণী সমৃদ্ধ গভীর অরণ্য সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা। পাশাপাশি অর্থকরী ফসলের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত চা-বাগানের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আজ হুমকির মুখে।
উপজেলায় প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের বসবাস। রয়েছে উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবনসহ বহু সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মক্তবÑমাদ্রাসা। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে সারি বেঁধে আসা-যাওয়া করে। চুনারুঘাটের উর্বর মাটিতে ফসল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে স্থানীয় শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ। এখানের মুক্ত বাতাসে পরিশ্রান্ত দেহ আরাম খুঁেজ পায়। কিন্তু বর্তমানে এ মুক্ত বাতাস দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শ্বাস-প্রশ্বাসসহ নানান অসুখে ভোগছেন উপজেলাবাসী।
প্রধান কারণ, চুনারুঘাটের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য হুমকি স্বরূপ ইটভাটা। ভাটার ক্ষতিকারক কালো ধোঁয়া দিনকে দিন মানবদেহ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটি খনন করে নেয়া হচ্ছে ফসলের জমি থেকে। যার ফলে ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। সাদা-কালা ধোঁয়ার কারণে পাখিদের আজকাল এখানে উড়ে বেড়াতে দেখা যায় না। দিন দিন মানুষের বিভিন্ন রোগ শ্বাস কষ্ট, হাঁচি, কাশিসহ বিভিন্ন চর্ম রোগ দেখা দিচ্ছে।
ইটভাটা যেন আজ হয়ে ওঠেছে মরণ ফাঁদ। সরকারি নিয়ম-নীতি ও প্রচলিত বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলি জমির উপর ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে ইটভাটা। আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। যার ফলে উজার হচ্ছে গ্রামসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলের বৃক্ষ। ভাটার সাদা-কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফলের গাছ আগের মতো ফল দেয় না। ফল ধরলেও তা অকালে ঝড়ে পড়ে। আম-কাঠালের এ মৌসুমে গাছভর্তি ফল থাকার কথা, কিন্তু ভাটার ধোয়ার ছোবলে ফলশূণ্য গাছ।
ভাটার চারপাশে রয়েছে আবাদি ফসল ও অসংখ্য ঘরবাড়ি। সরকারি নীতিমালায় রয়েছে, আবাদি জমি ও বসতবাড়ি থেকে এক কি. মি. পর হতে হবে ইটভাটার অবস্থান। কিন্তু সে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বেআইনিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ভাটাগুলো। আর প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ইটভাটা নির্মাণ করা হলেও সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯ ও ২০০১ সালের সংশোধিত আইন মোতাবেক সরকারি লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিত ইটভাটা স্থাপন, ইট প্রস্তুত করা কিংবা ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইনের ৫ ধারায় সংরক্ষিত, হুকুম দখল বা অধিগ্রহণকৃত বা সরকারের কাছে ন্যাস্ত আবাদি জমি, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি, আবাসিক এলাকা, ফলদ বাগান থেকে এক কি. মি. দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু উপজেলার কোনো ভাটার মালিক তার ধার-ধারছেন না।
একাধিক ইটভাটার মালিক তাদের ইটভাটার এক কি. মি. এর মধ্যে বসতবাড়ি বাগান ফসলি জমি থাকার কথাও স্বীকার করেন। উপজেলার অনেকেই জানান, অতিরিক্তভাবে ইটেরভাটা নির্মাণের ফলে তাদের ফসলি জমি, বনজ ও ফলদ বাগান ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ভাটার পাশ্ববর্তী জমিতে প্রচন্ড উত্তাপের কারণে আগের মতো ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। ফলের গাছ ও ফসলি জমিগুলোতে এখন আর আগের মত ফসল হয় না। ফলে খাদ্য সংকটে পড়তে হচ্ছে তাদেরকে।
কর্তৃপক্ষের এহেন উদাসীনতা ও রহস্যজনক কারণে আইন সচল না থাকায় ভাটাগুলো চলছে হরদম। ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভূগছেন জনসাধারণ।
অবৈধ ও অতিরিক্তভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার ছোবলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে আইনের কঠোর অবস্থান জরুরী। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য ভাটায় বায়ূ দূষণরোধক ইট তৈরির প্রযুক্তি সহ নানান আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যাবশ্যক।
প্রসঙ্গত, উপজেলায় ফসলি জমির উপর প্রায় ৩০টিরও বেশি ভাটা রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই অবৈধ ও অপরিকল্পিত।